ঢাকা ১১:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে বজ্র প্রতিরোধক তালগাছ

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৩:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ৬৭ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি :: ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ, ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা/ তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে। বইয়ের পাতায় কবিতা থাকলেও বাস্তবের সঙ্গে আজ এর কোনো মিল নেই।

কবিতার পঙক্তির ধারার ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় কালের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ বজ্র প্রতিরোধক তাল গাছ।

আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ উল্টো এই গাছ কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। নানা কারণ দেখিয়ে রাস্তার পাশের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন তাল গাছ কেটে বিভিন্ন করাতকলে বিক্রি করছে। এ কারণে ঝড়, বৃষ্টি ও বিজলী (বিদ্যুৎস্পর্শের) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখি সহ জীব বৈচিত্র্য।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও গ্রামের রাস্তা-ঘাট, পুকুরপাড় ও মাঠের মধ্যে সারিসারি তালগাছ ছিল। আষাঢ় মাস আসার আগে থেকেই বাবুই পাখি বাসা বুনতে শুরু করত। তাদের কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম। এখন হাতেগোনা গুটিকয়েক তালগাছ চোখে পড়ে। এখন আর মুখরিত হয় না বাবুই পাখির কিচির-মিচির শব্দে গ্রামবাংলার জনপদ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, তালগাছ প্রায় বিলুপ্ত। ফলে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যু বরণ করেছে ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ২৩৬ জন।২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে গড় মৃত্যুর হার ২১৬ জনের বেশি। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে তাল গাছের বিকল্প নেই। সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে চলে যায়।
অন্যদিকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে সরকারিভাবে ২০১৭সালে রাস্তার দুই পাশে নামমাত্র তালগাছের চারা-আঁটি রোপণ করা হয়েছিল। তবে বেশ কয়েক বছর আগে আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাকুরিয়া, মিঠাপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি সক্রিয়ভাবে রোপণ করেন হৃদয়ে আলফাডাঙ্গা নামে স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হৃদয়ে আলফাডাঙ্গার অন্যতম সদস্য মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, আলফাডাঙ্গা উপজেলাকে নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং বজ্রপাত প্রতিরোধে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে রাস্তার দুই পাশে তালের বীজ রোপন করেছি।

আলফাডাঙ্গা পৌর এলাকার ৮ নং ওয়ার্ডের মিঠাপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক তারা মিয়া বলেন, এ গাছ রোপণ করলে তাতে বেশি জমি দখল করে না তাই জমিও নষ্ট হয় না। কোনো সার ওষুধ ব্যবহার করতে হয় না। কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। রোপণ করার ১০ থেকে ১৫ বছর পরে তাল গাছে ফল ধরে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আলমগীর কবির বলেন, গ্রামের গরিব মানুষেরা একটি ঘর তৈরি করতে ঘরের তীর দেওয়ার জন্য পরিপক্ক তালগাছ মিলছে না। যদিও কাজের উপযোগী ২/১টি গাছ মিলছে, তার দাম আকাশছোঁয়া।এজন্য সরকারিভাবে তালগাছের চারা-আঁটি উপজেলা প্রত্যেকটা অঞ্চলে রোপন করা প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন।

আলফাডাঙ্গা সরকারি কলেজের প্রভাষক মোরাদ হোসেন তালুকদার বলেন, ২০-২৫ বছর আগে এসব এলাকায় তাল গাছের কদর ছিলো বেশি। আমরা আমাদের এলাকায় তালের নৌকা বানাতাম। এখন আগের মতো বড় বড় তালগাছ পাওয়া যায় না। বর্তমানে মানুষজন তাল গাছ কেটে ফেলে, কিন্তু নতুন করে কেউ আর রোপণ করে না।

এ বিষয়ে উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, যেভাবে তাল গাছ কাটা হচ্ছে, সেভাবে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না।সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের কারণে কৃষকের প্রাণহানি ঘটছে, যেখানে তাল গাছ থাকলে বজ্রপাতের ঝুকি হতে কৃষকরা রক্ষা পাবে । পাশাপাশি তালগাছ রোদে কৃষকদের আশ্রয় নেওয়ার জায়গা হিসেবে কাজ করে। এ গাছ রোপণের ব্যাপারে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

হারিয়ে যাচ্ছে বজ্র প্রতিরোধক তালগাছ

আপডেট সময় : ০৮:৫৩:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি :: ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ, ঐখানেতে বাস করে কানা বগীর ছা/ তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে। বইয়ের পাতায় কবিতা থাকলেও বাস্তবের সঙ্গে আজ এর কোনো মিল নেই।

কবিতার পঙক্তির ধারার ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় কালের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ বজ্র প্রতিরোধক তাল গাছ।

আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ উল্টো এই গাছ কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। নানা কারণ দেখিয়ে রাস্তার পাশের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন তাল গাছ কেটে বিভিন্ন করাতকলে বিক্রি করছে। এ কারণে ঝড়, বৃষ্টি ও বিজলী (বিদ্যুৎস্পর্শের) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখি সহ জীব বৈচিত্র্য।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও গ্রামের রাস্তা-ঘাট, পুকুরপাড় ও মাঠের মধ্যে সারিসারি তালগাছ ছিল। আষাঢ় মাস আসার আগে থেকেই বাবুই পাখি বাসা বুনতে শুরু করত। তাদের কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম। এখন হাতেগোনা গুটিকয়েক তালগাছ চোখে পড়ে। এখন আর মুখরিত হয় না বাবুই পাখির কিচির-মিচির শব্দে গ্রামবাংলার জনপদ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, তালগাছ প্রায় বিলুপ্ত। ফলে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যু বরণ করেছে ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ২৩৬ জন।২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরে গড় মৃত্যুর হার ২১৬ জনের বেশি। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে তাল গাছের বিকল্প নেই। সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে চলে যায়।
অন্যদিকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে সরকারিভাবে ২০১৭সালে রাস্তার দুই পাশে নামমাত্র তালগাছের চারা-আঁটি রোপণ করা হয়েছিল। তবে বেশ কয়েক বছর আগে আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাকুরিয়া, মিঠাপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি সক্রিয়ভাবে রোপণ করেন হৃদয়ে আলফাডাঙ্গা নামে স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হৃদয়ে আলফাডাঙ্গার অন্যতম সদস্য মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, আলফাডাঙ্গা উপজেলাকে নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং বজ্রপাত প্রতিরোধে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে রাস্তার দুই পাশে তালের বীজ রোপন করেছি।

আলফাডাঙ্গা পৌর এলাকার ৮ নং ওয়ার্ডের মিঠাপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক তারা মিয়া বলেন, এ গাছ রোপণ করলে তাতে বেশি জমি দখল করে না তাই জমিও নষ্ট হয় না। কোনো সার ওষুধ ব্যবহার করতে হয় না। কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। রোপণ করার ১০ থেকে ১৫ বছর পরে তাল গাছে ফল ধরে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আলমগীর কবির বলেন, গ্রামের গরিব মানুষেরা একটি ঘর তৈরি করতে ঘরের তীর দেওয়ার জন্য পরিপক্ক তালগাছ মিলছে না। যদিও কাজের উপযোগী ২/১টি গাছ মিলছে, তার দাম আকাশছোঁয়া।এজন্য সরকারিভাবে তালগাছের চারা-আঁটি উপজেলা প্রত্যেকটা অঞ্চলে রোপন করা প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন।

আলফাডাঙ্গা সরকারি কলেজের প্রভাষক মোরাদ হোসেন তালুকদার বলেন, ২০-২৫ বছর আগে এসব এলাকায় তাল গাছের কদর ছিলো বেশি। আমরা আমাদের এলাকায় তালের নৌকা বানাতাম। এখন আগের মতো বড় বড় তালগাছ পাওয়া যায় না। বর্তমানে মানুষজন তাল গাছ কেটে ফেলে, কিন্তু নতুন করে কেউ আর রোপণ করে না।

এ বিষয়ে উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, যেভাবে তাল গাছ কাটা হচ্ছে, সেভাবে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না।সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের কারণে কৃষকের প্রাণহানি ঘটছে, যেখানে তাল গাছ থাকলে বজ্রপাতের ঝুকি হতে কৃষকরা রক্ষা পাবে । পাশাপাশি তালগাছ রোদে কৃষকদের আশ্রয় নেওয়ার জায়গা হিসেবে কাজ করে। এ গাছ রোপণের ব্যাপারে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।